নিউ ইয়র্কের বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের অন্যরকম ‘লজ্জা’
নিজস্ব প্রতিবেদক: সদ্য সমাপ্ত নিউ ইয়র্ক বইমেলায় এসে সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে লজ্জায় ফিরে গেলেন তসলিমা নাসরিন। গত ১৬ জুলাই বইমেলার একটি পর্বে তসলিমা নাসরিনের অংশ গ্রহন করার কথা থাকলেও বইমেলা সিন্ডিকেটের কতিপয় ব্যক্তির মনোপলি সিদ্ধান্তের ফলে তসলিমা নাসরিনের জন্য নির্ধারিত পর্বে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কমিটির সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর রোষানলে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকে লজ্জা নিয়েই বইমেলা থেকে ফিরে যেতে হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে প্রবাসী বইপ্রেমী ও প্রবাসের সাহিত্যাঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
নিউ ইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত চারদিনব্যাপী বইমেলা শুরু হয় গত ১৪ জুলাই। বইমেলার পূর্ব নির্দ্ধারিত অনুষ্ঠানসূচীতে বিতর্কিত লেখিকা ও স্বদেশ নিষিদ্ধ তসলিমা নাসরিনের নাম তালিকায় ছিল না। তাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মেলায় কেউ আমন্ত্রণও জানাননি। তসলিমা নাসরিনের কিছু অতি উৎসাহী ভক্তের উদ্যোগে তসলিমা নাসরিন গত ১৫ জুলাই বিকেলে হঠাৎ বইমেলায় এসে হাজির হন। তাঁকে দেখেই মেলায় আগত দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন সেলফি তুলতে। তসলিমা নাসরিনের উপস্থিতিতে পুরো বইমেলায় চিত্রই পাল্টে যায়। প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসে উপস্থিত দর্শক ক্রেতার মাঝে। হঠাৎ ভক্তরা তাঁকে ঘিরে তার বই কিনে তসলিমা নাসরিনের অটোগ্রাফ নিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সেই সাথে চলে সেলফিবাজী। সময় যতই গড়ায় তাঁর হঠাৎ ভক্তদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
এ সময় বইমেলা কমিটির কয়েকজন ব্যক্তির তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে ১৬ জুলাই রবিবারে একটি পর্বে উপস্থিত থাকার জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে আমন্ত্রণ জানান তসলিমা নাসরিনকে। তিনি উপস্থিত থাকার জন্য সম্মতি প্রকাশ করেন। তার জন্য ২০ মিনিট সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়ার কথা বলা হয় তাঁকে।
এরপরই কমিটির সদস্যদের মধ্যে শুরু হয় কানাঘুষা। অনেকেই দ্বিমত পোষন করতে শুরু করেন। তসলিমা নাসরিনকে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? সিদ্ধান্ত বাতিল করা হোক এসব বিষয় নিয়ে কথিত কমিটির কথিত সদস্যরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। এ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত কমিটির মধ্যে চলে বাক-বিতন্ডা। শেষ পর্যন্ত তসলিমা নাসরিনকে অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ বাতিলের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত করা হয়। রবিবার সকালেই সিদ্ধান্তের এ বিষয়টি তসলিমা নাসরিনকে কথা জানানো হয় বলে জানা গেছে।
তসলিমা নাসরিন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের খবর শুনে বইমেলায় উপস্থিত দর্শক-ক্রেতারা অনেককেই তার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্ত দর্শক-ক্রেতারা যখন তারা জানতে পারেন মেলা কর্তৃপক্ষ তসলিমাকে বয়কট করেছে, তখন তসলিমা ভক্তরা হতাশ হয়ে পড়েন। তারা এ ধরণের হটকারী সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়েছেন।
১৬ জুলাই সকালে তসলিমা নাসরিন তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, নিউইয়র্কে বাংলা বইয়ের মেলা হচ্ছে। আমি আমন্ত্রিত নই। তবু প্রাণের টানে একবার মেলাটি দেখতে গেলাম। যেহেতু শুনেছি নিউ ইয়র্ক আর বাংলাদেশে কোনও ফারাক নেই, মৌলবাদের চাষ দুই অঞ্চলেই মহাসমারোহে চলছে, তাই আশঙ্কা খানিকটা ছিল। রুশদির ওপর হামলা তো এই নিউইয়র্কেই হয়েছে। যারা ধর্মের নামে খুন খারাবি করতে দ্বিধা করে না, তাদের সংখ্যাটা ঠিক কত আমার জানা নেই। কিন্তু খুন করতে তো মিছিলের দরকার হয় না, একটি ধর্মান্ধই ব্যাপারটি ঘটিয়ে ফেলতে পারে। বইয়ের স্টলগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে আশঙ্কা উবে যায়। যেন স্বজন বেষ্টিত আমি। অনেকেই শুভেচ্ছা জানাতে এলেন। অনেকেই বললেন, আমার লেখা তাদের শক্তি জোগায়, আমার লেখা তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। হিজাব আর বোরখা পরা কয়েকজন মেয়েও আমার জন্য তাঁদের ভালবাসার কথা জানিয়ে গেলেন।
বইমেলায় তাঁকে অংশ নেওয়া থেকে বাতিলের সিদ্ধান্ত জেনে এবং মেলা থেকে ফিরে তসলিমা নাসরিন তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন-‘বড় বড়’ লোকদের ক্ষুদ্রতা দেখলে আগে দুঃখ হতো, এখন হাসি পায়। তাঁদের বড়ত্ব আমাকে নিষিদ্ধ করে, নিশ্চিহ্ন করে প্রমাণ করতে হয়, আমাকে পাশে রেখে নয়।
তাঁর ভক্ত তাপস বসু লিখেছেন, সত্যিকারের বড় লোকেরা কিন্তু এই ধরণের আচরণ করেনা, তাই হঠাৎ উঠে আসা দুদিনের বড়োলোক তসলিমার মতো অতি উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাতে পারে না,অন্ধকারে মুখ লুকোয়। তাই এই ধরণের আচরণ করে।
শিবশংকর ঘোষ লিখেন, এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখছি না। তসলিমা অংশগ্রহণ করলে প্রচারের সবটুকু আলো ও একাই শুষে নিত ফলে কাউকে কাউকে অন্ধকারে থাকতে হতো এটা হজম করা মুস্কিল।এমন সিদ্ধান্তে তসলিমার এতটুকু অসম্মান হয়নি মুখ পুড়েছে আয়োজকদের।
ভজন সরকার লিখেছেন, প্রবাসের লেখক, শিল্পী যাই বলুন অধিকাংশই ধর্মান্ধ মৌলবাদী অসভ্য ইতর শ্রেণীর। এরা নিজের প্রচারের জন্য আপনার সাথে ছবি তুলবে কিন্ত প্রতিবাদ করবে না। আমি আয়োজকসহ অধিকাংশ মানুষকে ভালো ভাবেই চিনি। নিউইয়র্ক বইমেলার চেয়েও তসলিমা নাসরিন অনেক বিশাল। ভালো থাকবেন তসলিমা নাসরিন।
সুবর্না শিকদার লিখেছেন, শুধুই ঘেন্না হয়। মানুষের মধ্যেই ধরি না এদের। চেতনাই নেই যাদের, তাদের আবার কিসের শিক্ষা-দীক্ষা?
এদিকে ১৪ জুলাই বিকেলে ‘বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে’ তৈরি ফিতা কেটে বইমেলার উদ্বোধন করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ ঘটনা জাতীয় পতাকার অবমাননার সামিল বলে উল্লেখ করেছেন সচেতন প্রবাসীরা।
১৪ জুলাই বিকেলে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা পারফমিং আর্টস সেন্টারে ৩২তম মেলা যৌথভাবে উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সেতারা রহমান (বীর প্রতীক)ও কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান। দেশ ও প্রবাসীর বিভিন্ন লেখক, সাহিত্যিক ও কথিত বুদ্ধিজীবিদের উপস্থিতিতে তাঁরা ‘বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে’ তৈরি ফিতা কেটে বইমেলার উদ্বোধন ফিতা কেটে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় মেলা কমিটির সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি বিশ্বজিত সাহা। এ ঘটনা জাতীয় পতাকার চরম অবমাননা করা হচ্ছে জেনেও উপস্থিত কেউ এর প্রতিবাদ করেননি। মেলা উদ্বোধনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রবাসীদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
‘বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে’ তৈরি ফিতা কেটে বইমেলার উদ্বোধন করা প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনৈক প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বই মেলার উদ্বোধনীতে এ ধরণের ঘটনা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। উপস্থিত সকলেই কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক ও মুক্তিযোদ্ধা। জাতীয় পতাকার আদলে কোন কিছু তৈরি করে কাটা বা পোড়ানো জাতীয় পতাকার চরম অবমাননা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যক্তিদের কারো মাথায় এটা ঢুকলো না। আর আয়োজকরাই বা কীভাবে এটা তৈরি করেন তা ভাবতেও পারছি না। তারা সত্যিই যদি এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করে জাতীয় পতাকার অবমাননাকারী ও এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করছি। সেই সাথী তিনি এ ঘটনার জন্য নিন্দা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা হয়েছে এ প্রতিনিধির। তারা এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন, বই মেলার নামে সংঘবদ্ধ এই চক্রটির বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে আদম ব্যবসা বন্ধ হওয়া দরকার। গত ৩১ বছর ধরে সেই একই ব্যক্তিরাই বই মেলার সঙ্গে জড়িত থেকে অবৈধভাবে নানা ধরনের বাণিজ্য করে আসছেন। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি আরোপের পর বিশেষ করে এবারে বেশি আদম আমদানী হয়েছে কলকাতা থেকে। শুধু তাই নয় প্রতিবারের বইমেলাতেই মুসলমান লেখক প্রকাশকের চেয়ে সনাতনী লেখক প্রকাশকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্টরা।
বিপি।এসএম